চিচিঙ্গা আমাদের দেশের অতিপ্রিয় একটি গ্রীষ্মকালীন সবজি। এর অনেক ঔষধী গুণ আছে। চিচিঙ্গা বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে রেখা, কুশি, কইডা, কইধা, কইড্যা ইত্যাদি নামে পরিচিত। এটি আমাদের দেশে সকলের নিকট প্রিয় অন্যতম প্রধান গ্রীষ্মকালীন সবজি। এটি বাংলাদেশের প্রায় সকল অঞ্চলেই চাষ করা হয়। আসুন জেনে নেই চিচিঙ্গা চাষ করার পদ্ধতি।
★প্রয়োজনীয় জলবায়ু ও মাটিঃ
গ্রীষ্মকালে চিচিঙ্গা ভালো হয়। চিচিঙ্গার ভালো ফলনের জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার দরকার হয়। শীতে বা ঠাণ্ডায় বীজ গজাতে চায় না। শীতের দু´ তিন মাস বাদ দিলে বাংলাদেশে বছরের যেকোন সময় চিচিঙ্গা জন্মানো যায়। জলাবদ্ধতা চিচিঙ্গা একেবারেই সহ্য করতে পারে না। বেশি বৃষ্টিতে ফুলের পরগায়ন বিঘ্নিত হয় ও ফলন কমে যায়। শীতের দু´ তিন মাস বাদ দিলে বাংলাদেশে বছরের যেকোন সময় চিচিঙ্গা জন্মানো যায়। চিচিঙ্গা চাষের জন্য সারাদিন রোদ পড়ে এমন খোলামেলা জায়গা নির্বাচন করতে হবে।
★চিচিঙ্গা এর উল্লেখযোগ্য জাতঃ
আমাদের দেশে সাধারণত তিন ধরণের চিচিঙ্গা দেখা যায়। এগুলো হল ঝুম লং, সাদা সাভারী, কইডা বা বন চিচিঙ্গা। এছাড়াও বেশকিছু হাইব্রিড জাতের চিচিঙ্গাও পাওয়া যাচ্ছে আমাদের দেশে। তারমধ্যে রয়েছে তিস্তা, তুরাগ, সুরমা, রূপসা, ঢাকা গ্রিন, মধুমতি, বর্ণালী, চিত্রা, রোহিনী ইত্যাদি।
★কিভাবে চারা তৈরি করবেনঃ
পলিব্যাগে অর্ধেক গোবর ও অর্ধেক মাটি মিশিয়ে ভরে প্রতিটি পলিব্যাগে একটি করে চিচিঙ্গার বীজ পুঁতে চারা তৈরি করে নেয়া যায়। বীজের খোসা শক্ত হলে বীজ বোনার আগে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে নিলে বীজ তাড়াতাড়ি গজায়। চারা ১৫ থেকে ২০ দিন বয়সের হলে তা জমিতে লাগানোর উপযুক্ত হয়।
★চাষের উপযুক্ত জমি তৈরি ও চারা রোপনঃ
জানুয়ারি মাস বা ফেব্রুয়ারী মাস থেকে চিচিঙ্গা চাষের প্রস্তুতি নেওয়া যায়। যেসব জমি উঁচু ও বৃষ্টির পানি আটকে থাকে না এমন জমি প্রথমে আগাছা মুক্ত করতে হবে। এরপর ভালভাবে ৪ বার অথবা ৫ বার মই দিয়ে নিতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে যে কোন সময় চিচিঙ্গার বীজ বোনা যেতে পারে। জমিতে চিচিঙ্গা রোপনের পূর্বে বেড তৈরি করে নিতে হবে। দুই বেডের মাঝখানে ৩০ সেন্টিমিটার চওড়া ও ১৫ সেন্টিমিটার গভীর নালা থাকতে হবে। বসতবাড়িতে লাগানোর জন্য বেড তৈরি করার দরকার নেই। মাদা তৈরি করে সেখানে সরাসরি বীজ বুনে দেওয়া যায়। মাদায় সরাসরি বীজ বুনে ও পলিব্যাগে বীজ বুনে চারা তৈরি করে এসব চারা লাগিয়ে চিচিঙ্গা চাষ করা যায়। প্রতি মাদায় ২ টি করে বীজ মাটির অনাধিক ২ সেন্টিমিটার গভীরে পুঁতে দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখবেন বীজ বোনার আগে অবশ্যই বীজ শোধন করে নিতে হবে। এতে গজানো চারার রোগজনিত মৃত্যুহার কম।
★সার প্রয়োগ/ব্যবস্থাপনাঃ
এক শতক জমিতে শেষ চাষের সময় ৮০ কেজি গোবর, ৭০০ গ্রাম টিএসপি, ৬০০ গ্রাম এমওপি, ৪০০ গ্রাম জিপসাম, ৫০ গ্রাম দস্তাসার, ৪০ গ্রাম বোরাক্স এবং ৫০ গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। জমি তৈরির সময় চিচিঙ্গার জমিতে অর্ধেক গোবর সার পুরো জমিতে ছিটিয়ে মিশিয়ে চাষ দিতে হবে। বাকি অর্ধেক সার বীজ বোনা বা চারা লাগানোর ১০ দিন আগে মাদার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
★সেচ ও পানি নিষ্কাশনঃ
প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে। মাটি শুকিয়ে গেলে ফুল ঝরে যায় ফল বড় হয় না। তাই মাটি শুকানোর আগেই সেচ দিতে হবে। প্রত্যেকবার সার প্রয়োগের পর জমিতে পানি সেচ দিতে হবে। এরপর মাটিতে ´জো´ এলে চটা ভেঙে দিতে হবে। আবার বৃষ্টির পর গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। কারণ চিচিঙ্গা জলাবদ্ধতা একেবারেই সহ্য করতে পারে না।
★আগাছা ও নিড়ানিঃ
চিচিঙ্গার ক্ষেত সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। বিশেষ করে প্রতিবার ইউরিয়া সার দেয়ার আগে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
★পোকামাকড় ও রোগদমনঃ
চিচিঙ্গার সবচেয়ে বড় বালাই হল ফলের মাছি পোকা। ফলের মাছি পোকা চিচিঙ্গার কচি ফল নষ্ট করে। এই পোকা কচি ফলের গায়ে ছিদ্রকরে ডিম পাড়ে। আক্রান্ত ফল বিকৃত হয়ে যায়। আক্রান্ত ফুল ও ফল তুলে ধ্বংস করে দিতে হবে। হাত দিয়ে ধরে টিপে মেরে ফেলা এই পোকা দমনের সহজ পদ্ধতি। এছাড়াও আরও অনেক পোকা চিচিঙ্গা গাছ কে আক্রমণ করে। তাঁর মধ্যে কাঁটালে পোকা ও ইপিলাকনা বিটল অন্যতম। এরা চিচিঙ্গার পাতা জালের মতো ঝাঁঝরা করে খেয়ে ফেলে। এদের দূরীকরণে হাত দিয়ে টিপে মেরে ফেলতে হবে। অথবা ৫ মিলিলিটার নিমতেলের সাথে ৫ মিলিলিটার ট্রিকস বা তরল সাবান ১ লিটার পানিতে গুলে স্প্রে করে দিতে হবে। এছাড়াও চিচিঙ্গা গাছ অ্যানথ্রাকনোজ বা মোজাইক রোগ দ্বারা আক্রমণ হতে পারে।
★ফসল সংগ্রহ ও ফলনঃ
চারা গজানোর ৬০-৭০ দিন পর চিচিঙ্গা গাছ ফল দিতে থাকে। চিচিংগা কচি অবস্থায় তুলতে হয়। চিচিঙ্গা আহরণ দুই-তিন মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। চিচিঙ্গার মোট জীবনকাল প্রায় পাঁচ মাস।
স্ত্রীফুলের পরাগায়নের ১০-১৩ দিনের মধ্যে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়। ফল আহরণ একবার শুরু হলে তা দুই আড়াই মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে চিচিঙ্গার হেক্টর প্রতি ফলন ২০-২৫ টন (৮০-১০০ কেজি/শতাংশ)
★বীজ উৎপাদনে করনীয়ঃ
কৃত্রিম পরাগায়নঃ
বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আশেপাশে অন্য জাতের চিচিংগার গাছ থাকলে নির্বাচিত গাছের পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ফোটার আগে (সকাল ৯:০০ ঘটিকা থেকে দুপুর ২:০০ ঘটিকার মধ্যে) পেপার ব্যাগ দ্ধারা বেধেঁ নিতে হবে।
অতঃপর ফুল ফোটার পর কৃত্রিম পরাগায়ণ করতে হবে এবং পরাগায়ণ শেষে স্ত্রী ফুলটি আবার ব্যাগিং করে রাখতে হবে।
৩-৪ দিন পর ব্যাগ খুলে ফেলা যাবে। কৃত্রিম পরাগায়ণ অবশ্যই সকাল ৬:০০ ঘটিকা থেকে ৯:০০ ঘটিকার মধ্যেই সমাপ্ত করতে হবে।
You must log in to post a comment.