হাঁস পালন ও ব্যবস্থাপনাঃ
………………………………………………………………..
………………………………………………………………..
আমাদের দেশে গ্রামীণ এলাকায় অনেক বাড়িতেই হাঁস পালন করতে দেখা যায়। হাঁসের লালন-পালন খরচ কম এবং ঝামেলা বিহীন। হাঁসের মাংস সুস্বাদু এবং ডিম আকারে বড়। হাঁসের মাংস ও ডিমের বাজার চাহিদা রয়েছে। হাঁস পালন করলে পরিবারের খাদ্য চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বর্তমান শহর, উপশহর এবং গ্রামেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাঁসের খামার গড়ে উঠেছে। বসত বাড়িতে হাঁস চাষ একটি সহজ ও লাভজনক কাজ। বাড়ির গৃহিনী এবং ছেলে-মেয়েরা অল্প মূলধন নিয়ে ছোট পরিসরে হাঁসের খামার স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারে। পারিবারিক এই খামারে দেশি জাত ছাড়াও উন্নত জাতের হাঁস পালন করা যায়। এ অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে বাণিজ্যিক খামার প্রতিষ্ঠায় কাজে লাগে।
………………………………………………………………..
হাঁস পালনের উপকারিতাঃ
………………………………………………………………..
1. হাঁসের ডিম ও মাংস প্রাণীজ আমিষের অন্যতম উৎস।
2. হাঁসের ডিম ও মাংস বিক্রি করে পরিবারে বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।
3. হাঁসের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং প্রতিকূল পরিবেশে মানিয়ে চলতে পারে।
4. হাঁস ও মাছের চাষ এক সাথে করা যায়।
5. হাঁস হাওর-বিল, ডোবা-নালা ও ধানের জমিতে নিজেরা চরিয়ে খেতে পারে। এর ফলে হাঁসের প্রাকৃতিক খাবারের অভাব হয় না।
6. হাঁসের বিষ্ঠা ভালোমানের জৈব সার।
………………………………………………………………..
বাজার সম্ভাবনা
……………………………………………………………….
স্থানীয় বাজার ছাড়াও বড় বড় হাটে-বাজারে হাঁস বিক্রি করা যায়। হাঁস জবাই করে পালক খসিয়ে বাজারে বিক্রি করা যায়। সম্পূর্ণ হাঁস বিক্রি করা তুলনামূলক সহজ। ডিম সরাসরি বাজারে বিক্রি করা যায়।
………………………………………………………………..
হাঁস পালন কৌশল
………………………………………………………………..
হাঁসের জাত নির্বাচন
………………………………………………………………..
* দেশি হাঁস
দেশি হাঁস আকারে ছোট এবং ডিমও কম দেয়। এদের মধ্যে রয়েছে নাগেশ্বরী, মাটি হাঁস, সাদা হাঁস ও রাজ হাঁস।
………………………………………………………………..
* উন্নত হাঁস
………………………………………………………………..
খাকি ক্যাম্পবেল, চেরীভেলী, জিংডিং হাঁস ও ইন্ডিয়ান রানার ডিমের জন্য ভালো। খাকি ক্যাম্পবেল ও চেরীভেলী বছরে ভালো পরিবেশে ২৫০-৩৫০টি পর্যন্ত ডিম দেয়। মাংসের জন্য পোকিন, মাস্কভি ও সাদা পিকিং ভালো। এরা বছরে ৮০-১২০টি ডিম দেয়। এদের মাংস বেশ সুস্বাদু।
………………………………………………………………..
উন্নত হাঁসের জাতের বিবরণঃ
………………………………………………………………..
পিকিং / বেজিনঃ
………………………………………………………………..
উৎপত্তিঃ এ জাতের হাঁসের উৎপত্তি চীন দেশে।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. পালকের রং সাদা।
২. ডিমের রং সাদা।
৩. দেহের আকার বড়।
উপযোগীতাঃ
ইহা মাংসের জন্য প্রসিদ্ধ কারণ প্রাপ্ত বয়স্ক একটি হাঁসা প্রায় ৪.৫ কেজি এবং একটি হাঁসী ৪ কেজি ওজনের হয়ে থাকে। বৎসরে গড়ে প্রায় ১৫০ টি ডিম দেয়।
………………………………………………………………..
মাসকোভিঃ
উৎপত্তিঃ এ জাতের হাঁসের আদি জন্মস্হান দক্ষিণ আমেরিকা।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. পালকের রং সাদা ও কলো।
২. মাথায় লাল ঝুটি।
৩. ডিমের রং সাদা।
৪. দেহের আকার বড়।
উপযোগীতাঃ এ জাতের হাঁস মাংসের জন্য প্রসিদ্ধ কারণ প্রাপ্ত বয়স্ক একটি হাঁসা প্রায় ৫ কেজি এবং একটি হাঁসী ৪ কেজি ওজনের হয়ে থাকে। বৎসরে গড়ে প্রায় ১২০ টি ডিম দেয়।
………………………………………………………………..
জিনডিং
উৎপত্তিঃ ইহার উৎপত্তিস্হল চীন।
বৈশিষ্ট্যঃ
১. হাঁসীর পালকের রং খাকীর মাঝে কালো ফোটা এবং হাঁসার কালো ও সাদা মিশ্রিত।
২. ডিমের রং নীলাভ।
৩. ঠোঁট নীলাভ/হলদে।
উপযোগীতা ডিম-এর উদ্দেশ্যে এ জাতের হাঁস পালন করা হয়। বার্ষিক ডিম উৎপাদন গড়ে ২৭০-৩২৫ টি। বয়ঃ প্রাপ্তদের ওজন ২- ২.৫ কেজি হয়ে থাকে।।
………………………………………………………………..
হাঁস পালনের ক্ষেত্রে যে কোন একটি জাত বাছাই করতে হবে। একই খামারে নানা জাতের হাঁস রাখা ঠিক হবে না।
………………………………………………………………..
………………………………………………………………..
হাঁস পালন পদ্ধতিঃ
………………………………………………………………..
সাধরণত: তিন পদ্ধতিতে হাঁস পালন করা হয়। যেমন :
………………………………………………………………..
1. সম্পূর্ণ মুক্ত পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে প্রায় সারাদিন হাঁসকে মাঠের মধ্যে চরানো যায়। শুধু রাতে ঘরে রাখা হয়।
………………………………………………………………..
2. সম্পূর্ণ আবদ্ধ পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে দিনরাত হাঁসকে ঘরের মধ্যে রাখতে হয়। ঘরের মধ্যেই পানি ও খাদ্যের ব্যবস্থা থাকে।
………………………………………………………………..
3. অর্ধ আবদ্ধ-অর্ধমুক্ত পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে রাতে হাঁস ঘরে রাখতে হয়। দিনের বেলা কিছু সময় ঘরে এবং কিছু সময় বাইরে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। পানি ও খাদ্য এমনভাবে ভাগ করে দিতে হবে যেন কিছু ঘরে এবং কিছু বাইরে চরে খেতে পারে।
………………………………………………………………..
………………………………………………………………..
হাঁস এর বাসস্হানের জন্য স্হান নির্বাচনঃ
………………………………………………………………..
১. উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে যেন বন্যার সময় পানিতে ডুবে না যায়।
২. বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের পর্যাপ্ত সুবিধা থাকতে হবে।
৩. ভালো যোগাযোগ ব্যবস্হা থাকতে হবে।
৪. মাংস ও ডিম বাজারজাত করার সুবিধা থাকতে হবে।
৫. পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্হা থাকতে হবে।
৬. পানি নিস্কাশনের ব্যবস্হা থাকতে হবে।
৭. চারপাশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে।
৮. খোলামেলা ও নিরিবিলি পরিবেশ হতে হবে।
………………………………………………………………..
ঘরের প্রকৃতিঃ
হাঁস পালনের উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে এদের ঘর বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যেমন- হ্যাচারি ঘর, বাচ্চার ঘর, গ্রোয়ার ঘর, ডিমপাড়া ঘর। যেমন- একচালা বা শেড টাইপ, দোচালা বা গ্যাবল টাইপ (‘অ ’ টাইপ), কম্বিনেশন টাইপ ও মনিটর বা সেমিমনিটর টাইপ।
………………………………………………………………..
ঘরের পরিচর্যা ও জীবাণুমুক্ত করণ পদ্ধতিঃ
ঘরের লিটার পরিস্কার হতে হবে এবং জীবাণুনাশক, যেমন- চুন দিয়ে তা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। ঘরের দেয়াল-মেঝে ভালমত পানি দিয়ে পরিস্কার করতে হবে। তবে কস্টিক সোডা দিয়ে পরিষ্কার করলে ভালো হয় । ফিউমিগেশন শুরু করার পূর্বে দরজা, জানালা, ভেন্টিলেটর প্রভৃতি বন্ধ করতে হবে যাতে ঘরে কোনো বাতাস না ঢুকে। ঘরের প্রতি ২.৮ ঘন মিটার জায়গার জন্য ৬ গ্রাম পটাসিয়াম পার-ম্যাঙ্গানেট ও ১২০ মি.লি. ফরমালিন (৪০%) দিয়ে ফিউমিগেট করতে হবে।
………………………………………………………………..
ডিম ফোটানো
………………………………………………………………..
হাঁসীর বয়স ৬ মাস হবার আগেই ডিম দিতে পারে। একটি সাধারণ আকারের হাঁসী ১০-১৫টি ডিম নিয়ে ৩০-৩৩ দিন তাপে বসতে পারে। ফোটানোর জন্য ডিম উর্বর কিনা সেটা বাতি দিয়ে দেখতে হবে। ডিমে ১৫ দিন তাপ হলে পরীক্ষা করতে হবে। অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে অথবা টর্চলাইটের মাধ্যমে ডিম পরীক্ষা করতে হবে। ডিম উর্বর হলে সূতার মত পেচানো জাল দেখা যাবে। ডিম অনুর্বর হলে তার কুসুম পরিষ্কার দেখা যাবে এবং কোন ধরণের জাল বা চিহ্ন দেখা যাবে না।
………………………………………………………………..
………………………………………………………………..
বাচ্চা পালনঃ
………………………………………………………………..
বাচ্চা রাখার ঘর বা শেড অবশ্যই উঁচু জায়গায় (সমতল ভূমি হতে ১-১.৫ ফুট উচুঁ) নির্মাণ করতে হবে যেন ঘরের ভিটি কোন অবস্হায় ভিজা বা স্যাঁতস্যাঁতে না হয়। ঘরের মেঝে পাকা হলে ভাল হয়। ২-৩ ইঞ্চি পুরু করে ধানের শুকনো তুষ বা শুকনো কাঠের গুঁড়া মেঝের উপর বিছিয়ে দিতে হবে। মেঝে নিচ থেকে ভিজে উঠতে পারে সেজন্য প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ২/৩ বার লিটার উল্টিয়ে চুন মিশাতে হবে। এতে লিটার শুকনো থাকবে, জীবাণু ধংস হবে এবং দুর্গন্ধ দুর হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোনো অবস্হাতেই বৃষ্টির পানি ঘরের মেঝের উপর না পরে। কখনও লিটার ভিজে গেলে উহা ফেলে দিতে হবে এবং ড্রিংকার হতে খাবার পানি ঘরের মেঝের উপর না পরে। কখনও লিটার ভিজে গেলে উহা ফেলে দিতে হবে এবং সাথে সাথে শুকনো লিটার দিতে হবে। বাচ্চা সংগ্রহের পর এদেরকে প্রথমে ভিটামিন মিশ্রিত পানি খেতে দিতে হবে। তারপর শুকনো খাবার সামান্য পানিতে ভিজিয়ে খাওয়াতে হবে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩/৪ বার বাচ্চাকে খাবার দিতে হবে এবং প্রতি বাচ্চাকে ৫-১০ গ্রাম করে সুষম খাবার খাওয়াতে হবে।
………………………………………………………………..
লক্ষ্য রাখতে হবে ছোট বাচ্চার বেলায় খাবার দেবার সময় অবশ্যই পানির পাত্রে আগে পানি দিয়ে রাখতে হবে অর্থাৎ প্রথমে পানি দিয়ে পরে খাবার দিতে হবে নতুবা শুকনো খাবার বাচ্চার গলায় আটকে বাচ্চা মারা যেতে পারে। এক দিন বয়সের বাচ্চার জন্য ব্রুডিং-এর প্রয়োজন রয়েছে। প্রথম সপ্তাহে ঘরের তাপমাত্রা থাকবে ৯৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট, পরবর্তিতে প্রতি সপ্তাহে ৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রা করে কমাতে হবে। সাধারণতঃ গ্রীস্মকালে ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ এবং শীতকালে ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ পর্যন- বাচ্চাকে তাপ দিতে হবে। তবে অতি খরা অথবা অতি শীতে এর কিছুটা তারতম্য হতে পারে। বাংলাদেশের গ্রামের অনেক এলাকায় এখনও বিদ্যুৎ নেই, থাকলেও পর্যাপ্ত নহে, সে সব এলাকার ক্ষুদ্র খামারী হ্যারিকেন, হ্যাজাকলাইট, কেরোসিন অথবা মাটির চুলা ব্যবহার করে হাঁস-মুরগির বাচ্চাগুলোকে তাপ প্রদানের ব্যবস্হা করতে পারেন।
………………………………………………………………..
হাঁসের বাচ্চা পালনে বিবেচ্যঃ
1. হাঁসের বাচ্চাকে সবসময় উমে ও শুকনো স্থানে রাখতে হবে।
2. হাঁসের বাচ্চাকে ঝুড়ি বা মাটির উপর রাখলে ১-২ সপ্তাহ ধানের তুষ বা কাটা খড় দিতে হবে। কিছুটা বড় হলে মেঝের উপর বালি এবং ছাই দিতে হবে।
3. নতুন বাচ্চাকে প্রথমে মিহি খুদি, ভাত দিতে হবে। কয়েকদিন গেলে অন্যান্য খাদ্য যেমন ছোট কোঁচো, শামুকের মাংস কাটা এবং সবজির পাতা ইত্যাদি দিতে হবে।
4. বিড়াল, কুকুর, চিকা, বেজী ও কাকের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য বেড়া বা ঝাপি, পলো দিয়ে আটকিয়ে রাখতে হবে। ৬-৮ সপ্তাহ বয়স হলে আর আটকাতে হবে না।
………………………………………………………………..
আধুনিক পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা পালন ও ব্যবস্থাপনাঃ
………………………………………………………………..
আধুনিক পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা পালনের ক্ষেত্রে উন্নতমানের বাচ্চার জাত বাছাই করতে হবে।
………………………………………………………………..
ব্রুডার প্যান
1. হাঁসের ঘরকে কয়েক প্যানে ভাগ করে প্রতি প্যানে ১/২টি ব্রুডার স্থাপন করতে হবে।
2. ব্রুডারটির পরিধি প্রয়োজনে ছোট/বড় এবং উপরে/নিচে নামানো/উঠানো যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
………………………………………………………………..
তাপ ব্যবস্থা
………………………………………………………………..
সাধারণত বাল্বের মাধ্যমে অথবা গ্যাস দিয়ে ব্রুডারে তাপ দিতে হবে।
………………………………………………………………..
ব্রুডারের ভিতরের তাপ ব্যবস্থা
……………………………………………………………….
সপ্তাহ———-তাপমাত্রাঃ
১ম—————-৩৫-২৪ ডিগ্রি সে.
২য়——————-২৪-১৮ ডিঃ সে.
৩য়———————১৮-১৭ডিঃ সে.
………………………………………………………………..
বাইরে চরার ব্যবস্থা থাকলে ২য় সপ্তাহ পরে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক তাপমাত্রা বজায় রাখলেই হবে।
………………………………………………………………..
মেঝের ধরণ ও পরিমাপঃ
1. মেঝে অবশ্যই পাকা হতে হবে। তাছাড়া ইট বা পাথর দিয়ে শক্ত করে সমতল রাখতে হবে।
2. বাচ্চার দৌড়াদৌড়ি ও চরার জন্য বয়সানুযায়ী যে পরিমাণ জায়গা লাগবে তা নিচে উল্লেখ করা হলো
………………………………………………………………..
………………………………………………………………..
হাঁস এর খাদ্য ও পুষ্টি ব্যবস্হাপনাঃ
………………………………………………………………..
হাঁস প্রধানত দুই রকমের খাদ্য খায়।
যেমনঃ প্রাকৃতিক খাদ্য ও সম্পূরক খাদ্য।
………………………………………………………………..
প্রাকৃতিক খাদ্য :
হাঁস প্রাকৃতিক ও সম্পূরক খাদ্যের মাধ্যমে খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে। জলাশয়ের আগাছা, ক্ষুদেপানা, পোকামাকড়, কচি ঘাস পাতা, ঝিনুক, শামুক ও ছোট মাছ ইত্যাদি খেয়ে অর্ধেক খাদ্যের প্রয়োজন মেটায়।
………………………………………………………………..
সম্পূরক খাদ্য :
হাঁস ভিজা খাবার পছন্দ করে। এজন্য হাঁসের খাদ্যে সবসময় পানি মিশিয়ে দিতে হয়। সাধারণত ১-৮ সপ্তাহ বয়সের হাঁসকে দিনে ৪-৫ বার, ৮ সপ্তাহ বয়স থেকে দিনে ২-৩ বার এবং বাড়ন্ত- হাঁসকে দিনে ২ বার খাওয়াতে হয়। সকালে ও বিকালে হাঁসকে খাবার দিতে হয়। রাতের জন্য ঘরে খাবার দিয়ে রাখতে হবে।
………………………………………………………………..
হাঁসের দৈনিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণঃ
………………………………………………………………..
হাঁসের জাত, বয়স, খাদ্যের মান, বাসস্থান খাদ্যের আকার ও পরিবেশনের উপর নির্ভর করে।
জন্মের পর প্রথম সপ্তাহে দৈনিক ১৫ গ্রাম,
দ্বিতীয় সপ্তাহে ২৫ গ্রাম,
তৃতীয় সপ্তাহে ৩০ গ্রাম,
চতুর্থ সপ্তাহে ৩৫ গ্রাম,
পঞ্চম সপ্তাহে ৪০ গ্রাম,
ষষ্ঠ সপ্তাহে ৪৫ গ্রাম,
সপ্তম সপ্তাহে ৫০ গ্রাম,
অষ্টম সপ্তাহে ৫৫ গ্রাম,
বাড়ন্ত- বয়সে ৮৫ গ্রাম ও
………………………………………………………………..
বয়স্ক হাঁসকে দৈনিক ১২৫ গ্রাম খাদ্য দিতে হয়।
………………………………………………………………..
নিচে হাঁসের সুষম খাদ্য তৈরির খাদ্য উপাদান উল্লেখ করা হলো :
উপাদান– -বাচ্চার খাদ্য –পূর্ণবয়স্কের খাদ্য(গ্রাম)
ভাঙা গম ——- ৪৫০ —- ৪৫০
চালের কুঁড়া ——- ২৭০ ——- ৩০০
তিলের খৈল ——- ১৪০ ——- ১২০
মাছের গুঁড়া ——- ১২০ ——- ১০০
ঝিনুক চূণ ——- ১৫ ——- ২৫
লবণ ——- ——— ৫ ——- ৫
মোট ——- ১০০০ ——- ১০০০
ভিটামিন ও মিনারেল ১.৫ গ্রাম/ কেজি ও ২.০ গ্রাম/কেজি খাবারের পাত্র কাঠের, টিনের এ্যলুমিনিয়ামের হতে পারে।
………………………………………………………………..
অথবা
………………………………………………………………..
হাঁসের সুষম খাবারের আরেকটি তালিকাঃ
ঠিক সময়ে ডিম পাওয়ার জন্য হাঁসের সুষম খাদ্যের প্রয়োজন। খামারকারী নিজেও এই সুষম খাদ্য নিজে তৈরি করে নিতে পারে। এতে দামে যেমন সস্তা হয়, এবং নিজেও প্রচন্ড বল পেতে পারেন যে তিনি তাঁর হাঁসকে ভাল খাবার খাইয়েছেন।
………………………………………………………………..
সুষম খাদ্য তৈরির নিয়ম নিচে দেয়া হলো-
………………………………………………………………..
প্রতি ১০০ ভাগ খাবারের মধ্যে-
গম – ৩০ ভাগ;
ধান ভাঙ্গা – ৪০ ভাগ;
কালো তিল খোল – ১০ ভাগ;
সয়াবিন খোল – ১০ ভাগ;
শুঁটকি মাছের গুঁড়ো – ৮ ভাগ;
ঝিনুক ভাঙ্গা – ২ ভাগ।
………………………………………………………………..
ভিটামিন এ, বি২, ডি৩, ই, কে প্রতি ১০০ কেজি খাবারের ১০ গ্রাম মেশাতে হবে।এবং প্রতি কু্যইন্টাল হিসেবে কোলিন ক্লোরাইড দিতে হবে ৫০ গ্রাম। হাঁস ৬-৮ সপ্তাহ হলে গমের পরিমান কমিয়ে ছত্রাক মুক্ত মেশানো যেতে পারে। কোলিন ক্লোরাইড যেমন দিতে হবে বৃদ্ধির জন্য তেমনি ককসিডিয়া রোড় বন্ধ করার জন্য দিতে হবে ককসিডিওস্ট্যাট।
ককসিডিওস্ট্যাট দিতে হবে হাঁসের ১২ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত। মেশাবার হার প্রতি ১০০ কেজি খাবারের জন্য ৫০ গ্রাম। হাঁসকে গুগলি দিলে শুঁটকি মাছের পারিমান কমিয়ে দিতে হবে। এতে খাবারের দাম ও কমে যাবে।
………………………………………………………………..
………………………………………………………………..
জীব নিরাপত্তা( Biosecurity)ঃ
………………………………………………………………..
১। হাসের ঘরে ঢুকার পুরবে জিবানু নাসক মিশ্রিত পানি দিয়ে হাত ও পা ধুয়ে নিতে হবে।
২। ঘরের ভিতড় ও বাহিরে পরিস্কার ও শুকনা রাখতে হবে।
৩। বাহিরের লোক ঘরে ঢুক্তে দেয়া যাবেনা।
৪। বিশুদ্ধ পানি ও টাটকা খাদ্য দিতে হবে।
৫।নিয়মিত টিকা দিতে হবে।
৬। মরা হাঁস মাটিতে পুতে রাখতে হবে।
………………………………………………………………..
………………………………………………………………..
টিকা প্রদানের সময় সুচিঃ-
………………………………………………………………..
১। ডাক ভাইরাস হেপাটাইটিস-৫ দিন বয়সে ১ম মাত্রা -১ মিলি – বুকের মাংসে
২৪ দিন বয়সে বুস্তার ডোজ
………………………………………………………………..
২। ডাক প্লেগ – ১৮ দিন বয়সে ১ম মাত্রা -১ মিলি – বুকের মাংসে
৩৫ দিন বয়সে বুস্তার ডোজ
৪-৫ মাস বয়স অন্তর দিতে হবে
………………………………………………………………..
৩। ডাক কলেরা – ৪৫ দিন বয়সে১ম মাত্রা -১ মিলি – বুকের চামড়ার নিচে
৪-৫ মাস বয়স অন্তর দিতে হবে।
………………………………………………………………..
………………………………………………………………..
ডিম সংরক্ষণঃ
………………………………………………………………..
ডিম সংরক্ষণের কয়েকটি পদ্ধতি আছে যেমন:
………………………………………………………………..
১. ঠান্ডা জায়গায় ঘরের কাঁচা মেঝেতে গর্ত করে মাটির হাঁড়ি বসাতে হবে। হাঁড়ির চারপাশে কাঠ কয়লা ভিজিয়ে দিলে হাড়ির মধ্যে বেশ ঠান্ডা হবে। হাঁড়ির মধ্যে ডিম রেখে মাটির সরা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে বেশ কিছুদিন ডিম ভালো থাকবে।
২. ১৪০০ ফাঃ তাপমাত্রার গরম পানিতে ১৫ মিনিট ডিম সিদ্ধ করে বেশ কিছুদিন ডিম সংরক্ষণ করা যাবে
৩. ডিমের উপরিভাগের অসংখ্য ছোট ছোট ছিদ্র বন্ধ করার জন্য এক মিনিট খাঁটি সরিষার তেলের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে হবে। এ পদ্ধতিতে ডিম বেশ কিছুদিন ভালো থাকলেও এ ডিমে সরিষার তেলের ঝাঁজ পাওয়া যাবে।
চুনের পানিতে ডিম ডুবিয়ে রেখে ডিমের ছিদ্র বন্ধ করা যাবে। এক্ষেত্রে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে:
………………………………………………………………..
১ম ধাপঃ
একটি পাত্রে ১ লিটার পানি নিয়ে তার মধ্যে ১০০ গ্রাম চুন গুলে গরম করতে হবে।
………………………………………………………………..
২য় ধাপঃ
লবণ পানি ঠান্ডা হলে তার মধ্যে ২৫০ গ্রাম চুন ভালোভাবে গুলাতে হবে।
………………………………………………………………..
৩য় ধাপঃ
পাত্রটি একদিন রেখে দিলে নিচে তলানি জমবে।
………………………………………………………………..
৪র্থ ধাপঃ
নিচের তলানি না নেড়ে উপরের পরিষ্কার পানি আলাদা পাত্রে ঢেলে নিতে হবে।
………………………………………………………………..
৫ম ধাপঃ
………………………………………………………………..
এই পরিষ্কার পানিতে ২০ মিনিট তারের খাঁচায় করে ডিম ডুবাতে হবে।
………………………………………………………………..
৬ষ্ঠ ধাপঃ
খাঁচাসুদ্ধ ডিম ছায়ায় শুকিয়ে নিতে হবে।
………………………………………………………………..
……………………………………………………………….
রোগবালাই ও চিকিৎসাঃ
………………………………………………………………..
১. মড়কের হাত থেকে বাঁচাতে হাঁসকে নিয়মিত ওষুধ ও টিকা দিতে হবে।
২. ডাকপ্লেগ, রানীক্ষেত, হেপাটাইটিস, কলেরা, সালমোনেলোসিস, মাইকোটক্রিকোসিস সমস্যা এবং ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী টিকা এবং ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।
৩. হাঁসকে সবসময় পরিষ্কার-পরিছন্ন ভালো ও টাটকা খাবার দিতে হবে।
৪. নতুন হাঁস কিনলে কয়েকদিন আলাদা রাখতে হবে।
৫. অসুস্থ হাঁসকে চিকিৎসা করার সময় ভালো/সুস্থ হাঁস থেকে আলাদা রাখতে হবে।
৬. আয়োসান, ফিনাইল, লাইজল ইত্যাদি দিয়ে ঘর ও জিনিসপত্র ধুতে হবে এবং মাঝে মাঝে রোদে শুকিয়ে রোগমুক্ত করতে হবে।
………………………………………………………………..
ডাক প্লেগ রোগঃ
কারণঃ ভাইরাস সংক্রমণে হয়।
লক্ষণঃ
১. হাঁস আলো দেখলে ভয় পায়।
২. হাঁস সাঁতার কাটতে চায় না।
৩. পানি পিপাসা বৃদ্ধি পায়। খাদ্য গ্রহণে অনীহা হয়।
৪. নাক দিয়ে তরল পদার্থ বের হয়।
৫. সবুজ ও হলুদ রঙের পাতলা মলত্যাগ করে।
৬. পালক এলোমেলো হয়ে পড়ে।
৭. পা ও পাখা অবশ হয়। পাখা ঝুলে পড়ে।
৮. ঠোঁট নীল বর্ণ হয়।
৯. ঘাড় মাথা বাঁকা করে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কাঁপুনি হয়।
১০. চোখ ফুলে চোখের পাতা আটকে যায়।
১১. খুঁড়িয়ে হাঁটে।
১২. ডিম পাড়া হাঁস ডিম পাড়া কমিয়ে দেয়।
১৩. হাঁস হঠাৎ মারা যায়।
প্রতিরোধ ও প্রতিকার
১. জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা।
২. আক্রান্ত- হাঁস অন্যত্র সরিয়ে ফেলা।
৩. মৃত হাঁস মাটিতে পুঁতে ফেলা।
৪. সবকিছু জীবাণুমুক্ত রাখা।
৫. টিকা দেয়া। ১৫-২০ দিন বয়সের বাচ্চাকে প্রথমবার এবং পরে এক মাস বয়সে এবং ৬ মাস পরপর প্রতিটি হাঁসের রানের বা বুকের মাংসে ১ মি.লি. করে ইনজেকশন দিতে হয়।
………………………………………………………………..
হাঁসের কলেরাঃ
কারণঃ ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে হয়।
লক্ষণ
১. আক্রান্ত- হাঁস সবুজ বা হলুদ বর্ণের পাতলা মলত্যাগ করে।
২. মুখমণ্ডল, ঝুঁটি, গলকম্বল ও কানের লতি নীলাভ হয়।
৩. মাথা ও হাঁটু ফুলে যায়।
৪. ক্ষুদা মন্দা হয়। দেহ দুর্বল হয়।
৫. চোখের পাতা ফুলে যায়।
৬. নাক, মুখ ও চোখ দিয়ে তরল পদার্থ বের হয়।
৭. ডিম উৎপাদন কমে যায়।
৮. পালক উসকো খুসকো হয়। পালক ঝুলে পড়ে।
৯. মুরগি হঠাৎ মারা যায়।
প্রতিরোধ ও প্রতিকারঃ
১. জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা।
২. আক্রান্ত- হাঁস অন্যত্র সরিয়ে ফেলা।
৩. মৃত হাঁস মাটিতে পুঁতে ফেলা।
৪. সবকিছু জীবাণুমুক্ত রাখা।
৫. এ রোগের টিকা প্রতিটি হাঁসের ২ সপ্তাহ বয়সে রানের মাংসে ১ সিসি করে ইনজেকশন দিতে হয়।
৫. টেট্রাসাইকিন গ্রুপের ওষুধ পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হয়।
এছাড়াও হাঁস বার্ড ফু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। লক্ষণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকার ব্যবস্থা মুরগির বার্ড ফু এর মত।
………………………………………………………………..
………………………………………………………………..
মূলধনঃ
হাঁস পালন শুরু করার জন্য ২০০০ টাকার প্রয়োজন হবে। মূলধন সংগ্রহের জন্য ঋণের প্রয়োজন হলে নিকট আত্মীয়-স্বজন, সরকারী ও বেসরকারী ঋণদানকারী ব্যাংক(সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক , রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক) বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (আশা, গ্রামীণ ব্যাংক, ব্রাক, প্রশিকা) -এর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এসব সরকারি ও বেসরকারি ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) শর্ত সাপেক্ষে ঋণ দিয়ে থাকে।
………………………………………………………………..
………………………………………………………………..
হাঁস ও মুরগির মাংসের পুস্টি মানঃ-
মুরগি———–হাস
প্রোটিন ————–১২.৯%———১৩.৫%
চরবি—————–১০.৯%———১৪.৫%
অ্যাস—————–০.৯%———–১.০%
ড্রাইমেটার———–২৬.৪%———৩০.৩%
ডিমের ওজন———৫৭ গ্রাম——–৭৫ গ্রাম
………………………………………………………………..
………………………………………………………………..
খামার ব্যবস্হাপনা ও দৈনিক কার্যক্রম সূচিঃ
যে কোনো ধরনের খামারই হোক না কেনো তার ব্যবস্হাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রকৃতপক্ষে খামার ব্যবস্হাপনার উপরই খামারের লাভ লোকসান এমনকি খামারের ভবিষ্যত সসপ্রসারণ নির্ভর করে ।
………………………………………………………………..
ক) সকাল ৭ – ৯ টাঃ
১. জীবাণুমুক্ত অবস্হায় শেডে প্রবেশ করতে হবে এবং হাঁস-মুরগির সার্বিক অবস্হা ও আচরণ পরীক্ষা করতে হবে।
২. মৃত বাচ্চা/বাড়ন- বাচ্চা/মুরগি থাকলে তৎক্ষণাৎ অপসারণ করতে হবে।
৩. ডিম পাড়া বাসার দরজা খুলে দিতে হবে।
৪. পানির পাত্র/ খাবার পাত্র পরিস্কার করতে হবে।
৫. পাত্রে খাবার ও পানি না থাকলে তা পরিস্কার করে খাদ্য ও পানি সরবরাহ করতে হবে।
৬. লিটারের অবস্হা পরীক্ষা করতে হবে ও প্রয়োজন হলে পরিচর্যা করতে হবে।
৭. খাবার দেবার পর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আচরণ পরীক্ষা করতে হবে।
………………………………………………………………..
সকাল ১১- ১২ টাঃ
১. খাদ্য নাড়াচাড়া করে দিতে হবে।
২. পানি গরম ও ময়লা হলে পরিবর্তন করে পরিস্কার ও ঠান্ডা পানি দিতে হবে।
৩. ডিম সংগ্রহ করতে হবে।
………………………………………………………………..
বিকাল ৪ – ৫ টাঃ
১. পাত্রে খাদ্য পানি না থাকলে তা সরবরাহ করতে হবে।
২. ডিম সংগ্রহ করতে হবে।
৩. ডিম পাড়ার বাসা/বাক্সের দরজা বন্ধ করতে হবে।
৪. আচরণ পরীক্ষা করতে হবে।
………………………………………………………………..
………………………………………………………………..
সাপ্তাহিক কাজঃ
১. খাদ্য তৈরি করতে হবে।
২. বাচ্চা/ডেকী মুরগী/মুরগীর নমুনা ওজন গ্রহণ করতে হবে।
৩. ঘর পরিস্কার করতে হবে।
৪. ঘরের বাতি সপ্তাহে ২ দিন পরিস্কার করতে হবে। খাদ্য ও পানির পাত্র পরিস্কার করতে হবে এবং লিটার পরিচর্যা করতে হবে।
You must log in to post a comment.