বাটা মাছ চাষ পদ্ধতি
বাটা মাছ চাষ পদ্ধতি

বাটা মাছ চাষ পদ্ধতি

বাংলাদেশের ছোট মাছগুলোর মধ্যে বাটা/ইলিশ বাটা মাছ বাংলাদেশীদের খুব প্রিয় মাছ হিসাবে সমাদৃত। অতীতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক জলাশয় যেমনÐ নদী-নালা, খাল-বিল, প্লাবনভূমি, ধানক্ষেত, হাওর-বাঁওড়ে এসব মাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। কিন্তু নদীর উজানে চর জেগে উঠার জন্য পানির নাব্যতা কমে যাওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, ধানক্ষেতে কীটনাশকের ব্যবহার, বিল-ঝিল শুকিয়ে মাছ ধরাসহ নানাবিধ কারণে এই মাছের প্রজনন ও চারণক্ষেত্র সংকুচিত হয়। ফলে এ মাছের প্রাচুর্য্যতা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। বাজারে এ মাছের চাহিদা অত্যন্ত বেশি। বিপন্ন প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি রোধকল্পে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের গবেষণায় বাটা মাছের কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও  লালন-পালন এবং চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

 

বাটা মাছের প্রজননঃ এই মাছটি দেখতে অনেকটা রেবা মাছের মত। রুই জাতীয় মাছের সাথে বাটা মাছ চাষ করা হয়ে থাকে। মাছটির আকৃতি ৬-৮ ইঞ্চি হয়ে থাকে। বর্তমানে অনেক কার্প হ্যাচারিতে এ প্রজাতির মাছের রেণু উৎপাদন করা হয়ে থাকে। বাটা মাছ এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রজনন করে থাকে। প্রজননের জন্য দুই বছর বয়সের স্ত্রী ও পুরুষ মাছ নির্বাচন করতে হবে। উভয় মাছ পরিপক্ক হতে হবে। প্রজননের পূর্বে পরিপক্ক স্ত্রী ও পুরুষ মাছ আলাদা আলাদা ট্যাংকে রাখতে হয়। ট্যাংকে ৬-৭ ঘন্টা রাখার পর হরমোন ইনজেকশন দিতে হয়। কৃত্রিম প্রজননের জন্য পিজি হরমোন ব্যবহার করা উত্তম। নিন্মে বাটা মাছের প্রজননের ২টি পদ্ধতি বর্ণনা করা হলোঃ

পদ্ধতি-১ঃ কৃত্রিম প্রজননের জন্য স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে একটি মাত্র ডোজ দেওয়া হয়। প্রতি কেজি স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে যথাক্রমে ৫.০ মিগ্রা. ও ২.০ মিগ্রা. হরমোন ডোজ প্রয়োগ করতে হবে। ইনজেকশন দেওয়ার পর  সাথে সাথে ট্যাংকে হাপা স্থাপন করে মাছগুলি একত্রে ছেড়ে দিলে ৭/৮ ঘন্টার মধ্যে ডিম দেয়। তারপর হাপা  থেকে ডিমগুলো সার্কুলার ট্যাংকে রেখে পানির ফ্লো দিতে হবে। এ অবস্থায় ১৫/২০ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে রেণু বাহির হবে।

পদ্ধতি-২ঃ প্রথম ডোজ  প্রতি কেজি স্ত্রী মাছকে ১ মিগ্রা., ৬ ঘন্টা পর ২য় ডোজ ৪ মিগ্রা. হিসাবে ইনজেকশন দেওয়া হয়। প্রতি কেজি পুরুষ মাছকে ২ মিগ্রা. ইনজেকশন দিয়ে স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে একত্রে ট্যাংকে বা হাপায় দিলে ৬/৭ ঘন্টার মধ্যে ডিম দিয়ে দিবে। ১৫/২০ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে রেণু বাহির হয়। রেণু বের হওয়ার সময় পানির ফ্লো বেশি রাখতে হবে। পানির ফ্লো কম থাকলে রেণু মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডিমের খোসা সরানোর জন্য টুকরা জাল ব্যবহার করতে হবে। তারপর সাথে সাথে পানির ফ্লো দিয়ে দিতে হবে। রেণুর বয়স ৫০/৬০ ঘন্টা হলে রেণুকে খাবার দিতে হবে। মুরগীর ডিম সিদ্ধ করে ডিমের কুসুম ১ লিটার পানির মধ্যে মিশিয়ে ট্যাংকে বা ফানেলে দিতে হবে এবং ২০/২৫ মিনিট পর পুনরায় পানির ফ্লো অল্প করে দিতে হবে। এইভাবে খাবার দেওয়ার পর রেণুগুলোকে নার্সারি পুকুরে ছাড়তে হবে।

বাটা মাছের নার্সারি

বাটা মাছের নার্সারি করার পূর্বে পুকুর শুকানো প্রয়োজন। পুকুর ভালোভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে। প্রথমে চুন প্রতি শতাংশে ০.৫-১.০ কেজি হারে পানিতে মিশিয়ে অথবা শুকানো পাউডার অবস্থায় সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। তারপর ২/৩ ফুট পরিমাণ পানি দিতে হবে। প্রতি শতাংশে ৫-৮ কেজি কম্পোষ্ট পানিতে মিশিয়ে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। তিনদিন অপেক্ষা করার পর পুকুরে সুমিথিয়ন প্রতি শতাংশে ১০ মিলি. করে পানিতে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। তারপর জাল টেনে পুকুরের ময়লা আবর্জনা তুলে ফেলতে হবে এবং ময়দা প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম হারে পানিতে গুলে সমস্ত পুকুরে দিতে হবে। সুমিথিয়ন দেয়ার ২৪ ঘন্টা পার হলেই বাটা মাছের রেণু পোনা ছাড়তে হবে। রেণু ছাড়ার পরপরই খাবার হিসেবে রেণুর ওজনের সমপরিমাণ ময়দা ও প্রতি শতকে অর্ধেক সিদ্ধ ডিমের কুসুম পানিতে মিশিয়ে  সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। দুই দিন পর থেকে সরিষার খৈল রেণুর ওজনের সমপরিমাণ পূর্ব দিন ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকাল বেলা বেশি পানিতে মিশিয়ে পাতলা কাপড় দ্বারা ছেকে শুধু পানিটুকু সমস্ত পুকুরে দিতে হবে। পুনরায় সকাল বেলা সরিষার খৈল ভিজিয়ে বিকাল বেলা একই ভাবে দিতে হবে।

রেণুর বয়স ৫ দিন হলেই পুকুরে দিনে ২ বার হররা টানতে হবে। হররা টানার পরপরই খাবার প্রয়োগ করতে হবে। খাবার হিসেবে সরিষার খৈল অথবা নার্সারি ফিড পাউডার ব্যবহার করা যেতে পারে। ১০ দিন বয়স হলেই রেণুর ওজনের দেড়গুণ হারে খাবার দেওয়া যেতে পারে। বিশ দিন হলে দ্বিগুণ হারে, ৩০ দিন হলে তিনগুণ হারে খাবার দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে পুকুরে পানি দিতে হবে ও ৩০/৪০ দিন পর অন্য পুকুরে রেণু স্থানান্তর করতে হবে। অতপর পোনার ওজনের ৫০% হারে খাবার শুরু করতে হবে এবং ১০ দিন অন্তর অন্তর খাবার বৃদ্ধি করতে হবে।

বাটা মাছের চাষ পদ্ধতি

বাটা মাছ একই পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের সাথে মিশ্রচাষ করা হয়। মিশ্রচাষে পুকুরের বিভিন্ন স্তরের খাবারের পূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। যেমনÐ রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, কার্পিও ও গ্রাসকার্প ইত্যাদি মাছের সাথে বাটা মাছ চাষ করা হয়।

মিশ্রচাষের জন্য পুকুর নির্বাচনে নিচের বিষয়সমূহ লক্ষ্য রাখতে হবেঃ

             মিশ্রচাষের জন্য কমপক্ষে ৮-১০ মাস পানি থাকে এ রকম, অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির পুকুর হলে ভাল হয়।

             পুকুরের আয়তন ২০ শতাংশের চেয়ে বড় এবং পানির গড় গভীরতা ৫-৬ ফুট থাকা আবশ্যক।

             পুকুর পাড়ে বড় গাছ-পালা না থাকা বাঞ্ছনীয়।

             পুকুর প্রস্তুতির ধাপসমূহঃ মাছ চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুতির গুরুত্ব অপরিসীম। মাছের দৈহিক বৃদ্ধি ও রোগমুক্ত থাকার অনুকূলে পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পুকুর প্রস্তুতি আবশ্যক। তাই পোনা মজুদের পূর্বে ভালোভাবে পুকুর প্রস্তুত করতে হবে।

             পুকুরের পাড়ভাঙ্গা থাকলে মেরামত করে বা বেঁধে মজবুত করতে হবে।

             পুরাতন পুকুরের তলদেশে পঁচা কাদা থাকলে তা তুলে ফেলতে হবে।

             পাড়ে ঝোপঝাড় থাকলে লতাপাতা পুকুরে পড়ে পঁচে গিয়ে পানি নষ্ট করতে পারে। মাছ খেকো প্রাণী যেমন : সাপ, উদবিড়াল, গুইসাপ পানিতে আশ্রয় নিয়ে মাছ খেতে পারে। তাই পুকুরের আগাছা, পাড়ের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে হবে।

             পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম (৪ফুট পানির গভীরতায়) রোটেনন প্রয়োগ করে অবাঞ্ছিত ও রাক্ষুসে মাছ অপসারণ করতে হবে।

             অবাঞ্ছিত ও রাক্ষুসে মাছ অপসারণ করার পর প্রতি শতাংশে ১.০ কেজি চুন সমস্ত পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।

             চুন প্রয়োগের ৩-৪ দিন পর প্রতি শতাংশে ৬-৮ কেজি হারে কম্পোষ্ট সার সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।

             কম্পোষ্ট সার প্রয়োগের ৩ দিন পরে প্রতি শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি পুকুরে ব্যবহার করতে হবে।

পোনা মজুদ

পোনা মজুদের হার

             ভাল উৎপাদন পাওয়ার জন্য সুস্থ ও সবল পোনা নির্দিষ্ট হারে মজুদ করা উচিত।

             প্রতি শতাংশে ১০-১২ সেমি. আকারের ৪৫-৬০ টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে।

             পোনা প্রাপ্তির ওপর মজুদের সময় নির্ভর করে। তবে মার্চ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত মাছ দ্রæত বাড়ে বিধায় পোনা মার্চ মাসের মধ্যেই মজুদ করতে পারলে ভাল হয়।

             পুকুরে প্রচুর পরিমাণে মাছের প্রাকৃতিক খাবার জন্মানোর জন্য পোনা মজুদের এক সপ্তাহ পর থেকে সার  প্রয়োগ করতে হবে।

             প্রতি শতাংশে প্রথম সপ্তাহে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি দিতে হবে এবং পরবর্তী সপ্তাহে প্রতি শতাংশে ৪-৬ কেজি কম্পোষ্ট সার দিতে হবে।

             এভাবে পর্যায়ক্রমে অজৈব ও জৈব সার পুকুরে প্রয়োগ করলে মাছের উৎপাদন ভাল হয়।

             পুকুরের পানি যদি অত্যধিক সবুজ রং ধারণ করে তা হলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।

খাদ্য প্রয়োগ

             পুকুরে ব্যবহৃত সারে যে প্রাকৃতিক খাদ্যকণা জন্মে তাতে মাছের পুষ্টি সম্পূর্ণ হয় না, তাই মাছের দ্রæত বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার সরবরাহ করতে হবে।

             সম্পূরক খাবার হিসেবে চালের কূঁড়া (৮০%), সরিষার খৈল (১৫%) ও ফিশমিল (০৫%) এর মিশ্রণ পুকুরে সরবরাহ করা যেতে পারে।

             মাছ ছাড়ার ১৫ দিন থেকে প্রতিদিন সকালে মজুদকৃত মাছের ওজনের শতকরা ২-৫ ভাগ সম্পূরক খাদ্য দিতে হবে।

             সপ্তাহে ১ দিন সম্পূরক খাবার বন্ধ রাখতে হবে। তাছাড়া মেঘলা দিনে খাদ্য সরবরাহ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

             মাছ মজুদের পর প্রতি মাসে একবার জাল টেনে মাছের নমুনায়নের মাধ্যমে ওজন জেনে খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে।

ব্যবস্থাপনা

             পুকুরে সর্বদা আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে।

             পুকুরের পানি দ্রæত কমে গেলে অন্য কোন উৎস হতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

             পানির স্বচ্ছতা ৮ সেমি. নিচে নেমে গেলে সার ও খাবার দেয়া বন্ধ রাখতে হবে।

             পানিতে অক্সিজেনের অভাব হলে মাছ পানির উপরে উঠে খাবি খেতে থাকে। এ অবস্থায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ বা অক্সিজেন বৃদ্ধিকারক ঔষধ ব্যবহার করতে হবে।

             মাঝে মাঝে হররা টেনে পুকুরের তলার বিষাক্ত গ্যাস দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে।

মাছ আহরণ

             উল্লিখিত পদ্ধতিতে ৬-৭ মাসে এই মাছ খাবার উপযোগী এবং বিক্রিয়যোগ্য হয়।

             মাছ ধরার জন্য ঝাকি জাল বা টানা বেড়জাল ব্যবহার করা যেতে পারে।

             এ পদ্ধতিতে মাছের মিশ্রচাষ করে হেক্টর প্রতি এক ফসলে ৫.৫-৬.০ টন মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।

Similar Posts

X
%d bloggers like this: