হলুদ চাষ পদ্ধতি
হলুদ চাষ পদ্ধতি

হলুদ চাষ পদ্ধতি

লুদ মসলা হিসেবে একটি জনপ্রিয়, বহুল ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। আমাদের প্রতিদিনের রান্নায় হলুদের ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। মসলা হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও অনেক ধরণের প্রসাধনী কাজে, রং শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে হলুদ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়াও হলুদের অনেক ভেষজ গুণও রয়েছে।

বাংলাদেশে প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে হলুদের চাষ হয়। দেশে হলুদের উৎপাদন ১ লক্ষ ৮০ হাজার টন।

পুষ্টিমূল্যঃ প্রতি ১০০ গ্রাম হলুদের পুষ্টিমাণ-

উপাদান পরিমাণ
জলীয় অংশ ১৩.১ গ্রাম
খনিজ পদার্থ ৩.৫ গ্রাম
আঁশ ২.৬ গ্রাম
খাদ্য শক্তি ৩৪৯ কিলোক্যালরী
আমিষ ৬.৩ গ্রাম
চর্বি ৫.১ গ্রাম
শর্করা ৬৯.৪ গ্রাম
ক্যালসিয়াম ১৫০ মিলিগ্রাম
আয়রন ১৮.৬ মিলিগ্রাম
ক্যারোটিন ৩০ মাইক্রোগ্রাম
ভিটামিন-বি ১ ০.০৩ মিলিগ্রাম

সূত্র: দেশীয় খাদ্য দ্রব্যের পুষ্টিমাণ, পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 ভেষজগুণঃ

  • কাঁচা হলুদ খেলে চর্মরোগ দূর হয়।
  • গরম চুন ও হলুদ মিশ্রণের প্রলেপ ব্যথা কমায়।
  • হলুদ রক্ত পরিষ্কার করে এবং হজমে সহায়তা করে।
  • গ্যাসজনিত কারণে পেটের ব্যথা হলে ও বাতজনিত রোগ সারাতে হলুদ ব্যবহার হয়।
  • হলুদ মুত্রনালীর রোগ নিবারণ করে থাকে।
  • হলুদ কাটা স্থানের ক্ষত শুকাতে সহায়তা করে।

উপযুক্ত জমি ও মাটিঃ সব ধরণের মাটিতে চাষ করা গেলেও উর্বর দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি হলুদের জন্য ভালো। যে কোন ফলের বাগানের শুরুতে সাথী ফসল হিসেবে হলুদ চাষ লাভজনক। আবার সম্পূর্ণ ছায়াযুক্ত ফলের বাগানে চাষ করলে ফলন খুবই অল্প হবে, তবে অর্ধেক ছায়া অর্ধেক আলো এমন বড় ফলের বাগানে চাষ করালে ভালো ফল পাওয়া যাবে।

জাত পরিচিতিঃ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত হলুদের ৫ টি উচ্চ ফলনশীল জাত হচ্ছে (ক) বারি হলুদ-১ (ডিমলা), (খ) বারি হলুদ-২ (সিন্দুরী), (গ) বারি হলুদ-৩, বারি হলুদ-৪, বারি হলুদ-৫। নিম্নে জাতের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো-

জাতের বৈশিষ্ট্যঃ

বৈশিষ্ট্য বারি হলুদ-১ (ডিমলা) বারি হলুদ-২ (সিন্দুরী) বারি হলুদ-৩ বারি হলুদ-৪ বারি হলুদ-৪
গাছের উচ্চতা ১০৫-১২০ সেমি ৬০-৭০ সেমি ১১০-১২৫ সেমি ১১০-১২০ সেমি ১২০-১৩৫ সেমি
পাতার সংখ্যা ৯-১০ টি ২২-২৮ টি ২৪-৩০ টি
গোছার সংখ্যা ২-৩ টি ৫০-৫৫ টি ৬২-৬৫ টি
ছড়ার সংখ্যা ৭-৮ টি ৭-৮ টি ৬- ১০ টি ২২-২৫ টি ২০-২২ টি
মোথার ওজন ১২৫-১৩০ গ্রাম ৮৫-৯০ গ্রাম ১৫০-১৮০ গ্রাম ৫৫-৬০ গ্রাম ৩০-৪০ গ্রাম
হলুদের ওজন ৪০০-৪২০ গ্রাম ৩৭৫-৩৮০ গ্রাম ৭০০-৮০০ গ্রাম
রং গাঢ় হলুদ গাঢ় হলুদ গাঢ় হলুদ কমলা হলুদ গাঢ় কমলা হলুদ
ফলন ২৮-৩২ টন ২০-২৫ টন ২৫-৩০ টন ২৮-৩০ টন ১৮-২০ টন

ডিমলা জাতটি স্থানীয় জাতের তুলনায় ৩ গুণ এবং সুন্দরী জাতটি স্থানীয় জাতের তুলনায় ২ গুণ ফলন বেশি দেয়।

বীজ লাগানোঃ চৈত্র মাস কন্দ লাগানোর উপযুক্ত সময়। সাধারণতঃ ১৫-২০ গ্রাম ওজনের ১-২টি ঝুঁড়ি বিশিষ্ট কন্দ লাগাতে হয়। ৫০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে সারি করে ২৫ সেন্টিমিটার দূরে দূরে ৫-৭ সেন্টিমিটার গভীরে কন্দ লাগাতে হয়। প্রতি হেক্টরে ২৫০০ কেজি কন্দ প্রয়োজন হয়। কন্দ লাগানোর পর ভেলী করে দিতে হয়।

সার ব্যবস্থাপনাঃ জমির উর্বরতার উপর সারের পরিমাণ নির্ভর করে। সাধারণতঃ প্রতি হেক্টরে সারের পরিমাণ হলোঃ গোবর ৪-৬ টন, ইউরিয়া ২০০-২৪০ কেজি, টিএসপি ১৭০-১৯০ কেজি, এমওপি ১৬০-১৮০ কেজি, জিপসাম ১০৫-১২০ কেজি ও জিংক সালফেট ২-৩ কেজি। জমি তৈরির সময় সমুদয় গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট ও ৮০ কেজি এমওপি সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। কন্দ লাগানোর ৫০-৬০ দিন পর ১০০-১২০ কেজি ইউরিয়া ভেলী হালকাভাবে কুপিয়ে প্রয়োগ করে আবার ভেলী করে দিতে হয়। ১ম কিস্তির ৫০-৬০ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তি এবং আরও ৫০-৬০ দিন পর তৃতীয় কিস্তির সার উপরি প্রয়োগ করতে হয়। ২য় ও ৩য় কিস্তির উপরি সার হিসেবে প্রতি হেক্টরে প্রতিবারে ৫০-৬০ কেজি ইউরিয়া ও ৪০-৪৫ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হয়। ২য় ও ৩য় কিস্তির সার সারির মাঝে প্রয়োগ করে কোঁদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে এবং সামান্য মাটি ভেলীতে দিতে হবে।

সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনাঃ মাটিতে রস না থাকলে মাঝে মাঝে সেচ দিতে হবে। বৃষ্টির পানি যাতে গাছের গোড়ায় না জমে সেজন্য নালা করে পানি বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আগাছা দেখা দিলে তা পরিষ্কার করতে হবে। তবে সার উপরি প্রয়োগের সময় আগাছা পরিষ্কার করে প্রয়োগ করা ভালো।

পোকামাকড় দমন ব্যবস্থপনাঃ

হলুদের মাঝরা পোকাঃ কান্ড আক্রমণ করে বলে গাছের বৃদ্ধি ব্যহত হয়। ফলে উৎপাদন কম হয়। এ পোকার মথ (মা) কমলা হলুদ রঙের এবং পাখার উপর কালো বর্ণের ফোটা থাকে। কীড়া হালকা বাদামী বর্ণের। গায়ে সুক্ষ্ণ শুং থাকে।

ক্ষতির ধরনঃ পোকা কান্ড ছিদ্র করে ভিতরের দিকে খায় বলে পাতা হলুদ হয়ে যায়।  অনেক সময় ডেড হার্ট লক্ষণ দেখা যায়। আক্রান্ত কান্ডে ছিদ্র ও কীড়ার মল দেখা যায়। আর্দ্র আবহাওয়ায় এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়।

প্রতিকারঃ

  • আক্রান্ত ডগা তুলে ফেলা ও সম্ভব হলে পোকার কীড়া ধরে মেরা ফেলা
  • চাষের সময় দানাদার কীটনাশক যেমন কারটাপ ৪ জি ব্যবহার করতে হবে।
  • অধিক আক্রমণে অনুমোদিত কীটনাশক যেমন-রিজেন্ট ১ মিলি/লিটার, মার্শাল ৩ মিলি/লিটার, কারটাপ ২.৮ গ্রাম/ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

রাইজোম স্কেল পোকাঃ এ পোকা রাইজোম (হলুদ) আক্রমণ করে বলে ক্ষেতের আইল থেকে সহজে বুঝা যায় না। ফলে প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। পূর্ণাঙ্গ স্কেল পোকা উজ্জল হলুদ বর্ণের এবং শরীর গোলাকার। এদের শরীর মোমের মত স্কেল দ্ধারা আবৃত থাকে।

ক্ষতির ধরনঃ ফসলের শেষ পর্যায়ে রাইজোম এ পোকার আক্রমণ দেখা যায়। পূর্নাঙ্গ ও নিম্ফ পোকা রাইজোমের রস চুষে খায় বলে রাইজোম আকারে ছোট হয়। রাইজোম কুঁচকে যায় ও অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা কমে যায়। আক্রান্ত রাইজোম গুদামে রাখলে সেখানে পচন ধরতে পারে। আর্দ্র আবহাওয়ায় এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়।

প্রতিকারঃ জুলাই- আগস্ট মাসে আক্রান্ত রাইজোম তুলে ধ্বংশ করতে হবে। স্কেল আক্রান্ত রাইজোম বাদ দিয়ে গুদামজাত করতে হবে। মাঠে আক্রমণ দেখা দিলে ও গুদামে রাখার পূর্বে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

বিছা পোকাঃ এ পোকার কীড়া ছোট অবস্থায় একত্রে থাকে ও বড় হলে পুরো মাঠে ছড়িয়ে পড়ে বিধায় প্রাথমিক অবস্থায় এদের দমন করা উচিৎ। এটি মথ জাতীয় পোকা এবং কীড়ার শরীর লোমে ঢাকা থাকে। কীড়াগুলো ক্ষতিকারক।

লক্ষণঃ এ পোকার আক্রমণ মাঝে মাঝে দেখা যায়। কীড়া পাতা ও গাছের নরম অংশ খায়। আক্রমনের মাত্রা বেশি হলে পুরো গাছ পাতা বিহীন হয়।

প্রতিকারঃ আলোর ফাঁদ দিয়ে মথ আকৃষ্ট করে মারা। কীড়া দলবদ্ধ থাকাকালীন সংগ্রহ করে হাত দিয়ে পিষে মারা।  ক্ষেতের মাঝে কঞ্চি পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করলে মথ, কীড়া ইত্যাদি ধরে খায়। শিকারী গান্ধী ও পরজীবী পোকা সংরক্ষণ। আক্রান্ত  ক্ষেতের  চারিদিকে নালা করে কেরোসিন মিশ্রিত পানি রাখলে কীড়াগুলো ঐ পানিতে পড়ে মারা যায়। সময়মত আগাছা ও মরা পাতা পরিষ্কার করা। অনুমোদিত কীটনাশক নির্ধারিত মাত্রায় ব্যবহার করা।

হলুদের থ্রিপসঃ  এ পোকা ছোট কিন্তু পাতার রস চুষে খায় বিধায় গাছ দূর্বল হয়ে পড়ে। সে কারণে ক্ষেতের মধ্যে পাতা বিবর্ণ দেখালে কাছে গিয়ে মনোযোগ সহকারে দেখা উচিৎ, তা না হলে ফলন অনেক কমে যাবে।  পোকা আকৃতিতে খুব ছোট। স্ত্রী পোকা সরু, হলুদাভ। পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ গাঢ় বাদামী। বাচ্চা সাদা বা হলুদ। এদের পিঠের উপর লম্বা দাগ থাকে।

ক্ষতির ধরনঃ এরা রস চুষে খায় বলে আক্রান্ত পাতা রূপালী রং ধারণ করে। আক্রান্ত পাতায় বাদামী দাগ বা ফোঁটা দেখা যায়। অধিক আক্রমণে পাতা শুকিয়ে যায় ও ঢলে পড়ে। রাইজোম আকারে ছোট ও বিকৃত হয়।

দমন ব্যবস্থাপনাঃ

  • সাদা রঙের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করা।
  • শুধু মাত্র পানি স্প্রে করে।
  • ক্ষেতে মাকড়সার সংখ্যা বৃদ্ধি করে এ পোকা দমন করা যায়।
  • সাবানের গুঁড়া ৩-৫ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করা;
  • আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক যেমন-সুমিথিয়ন/ম্যালাথিয়ন/মিপসিন/ সপসিন/ রগর ২ মিলি/ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর স্প্রে করে এ পোকা দমনে রাখা যায়।

বিশেষ পরিচর্যাঃ হলুদের ফলন বৃদ্ধি এবং জমি থেকে পানি বের হওয়ার সুবিধার জন্য ২ থেকে ৩ বার দুই সারির মাঝখান থেকে মাটি তুলে গাছের গোড়ায় দিতে হবে। হলুদ রোপণ করার পর নালার  উপরে  মাটির রস ধরে রাখার জন্য শুকনো পাতা অথবা খড় দিতে হয়

ফসল সংগ্রহঃ সাধারণত লাগানোর ৯-১০ মাস পর পাতা শুকিয়ে গেলে হলুদ সংগ্রহ করা হয়। প্রতি হেক্টরে ২৫-৩০ টন কাঁচা হলুদ পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে একই জমিতে প্রতি বছর হলুদ বা আদা ফসল চাষ করা উচিত নয়

Similar Posts

X
%d bloggers like this: