পৃথিবীর একক জাতের মধ্যে মোট সংখ্যায় দ্বিতীয় এবং সিঙ্গেল পারপাস ডেইরি গরু হিসাবে সংখ্যায় প্রথম গরুর নাম হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান (সংক্ষেপে : ল্যাটিন আমেরিকাতে হোলস্টাইন এবং ইউরোপ ও এশিয়া আফ্রিকা তে ফ্রিজিয়ান ডাকা হয়)। বিশ্বের সবচে বেশি দুধ উৎপাদনকারী গাভী এবং বিশ্বের মোট উৎপাদিত দুধের প্রায় ৫০% হোলস্টাইন থেকেই উৎপাদিত হয় এবং এটাকে মূলত সিঙ্গেল পারপাস (শুধু দুধ উৎপাদন) গরু হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও এই জাতের ষাঁড় ও বৃহৎ আকৃতির হয়ে থাকে।
গড় ওজন : ষাঁড় : ৭০০-১০০০ কেজি।
গাভী : ৬০০-৮০০ কেজি।
হোলস্টাইন অর্থ সাদাকালো ডোরাকাটা আর স্থানের নাম ফ্রিসল্যান্ড এর সাথে মিলিয়ে এই গরুর নাম হয় হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান। বাভারিয়া (বর্তমান জার্মানি) এবং ফ্রিসল্যান্ড (বর্তমান নর্থ হল্যান্ড) এই গরুর আদি উৎস স্থান।
ইতিহাস :
নেদারল্যান্ড হোলস্টাইন গরুর ইতিহাস প্রায় ২০০০ বছরের। পরবর্তীতে (সঠিক সময় জানা যায়না) বাভারিয়া (জার্মানি) থেকে কালো জাতের গরু এবং ফিরিসল্যান্ড (নেদারল্যান্ড) এর সাদা জাতের গরুর ক্রস এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয় যুগান্তকারী এক নতুন কালো সাদা ব্রীড এর যার দুধ উৎপাদন ক্ষমতা সবাইকে চমকে দেয়, যার নাম দেয়া হয় হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান। পৃথিবীতে এখনো পিওর ফ্রিজিয়ান গরু পাওয়া গেলেও নতুন ক্রস ব্রীড দ্রুত গতিতে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে।
১৮৫২ : আমেরিকা তে হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান গরুর আমদানি।
১৮৮৪ : ব্রীডারস জে, ছি, এইচ গ্রিগ এর মাধ্যমে নিউজিল্যান্ড এ এই জাতের গরু আমদানি।
১৮৮৫ : আমেরিকাল হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান ব্রিডিং এসোসিয়েশন গঠন।
১৮৮৬ : অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন একটা হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান ষাঁড় এবং ছয়টা গাভী আমদানি করা হয় যেখানে এখন অস্ট্রেলিয়ার ৭০% দুধ উৎপাদন হয় এই জাত থেকে।
১৯৪৬ : যুক্তরাজ্যে হোলস্টাইন ব্রিডিং এসোসিয়েশন গঠন, যদিও আঠারো শতকে সেখানে এই জাতের গরু আমদানি করা হয়।
পালনকারী দেশ এবং সংখ্যাঃ
পৃথিবীতে হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান এর সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়না, তবে ১৯৯০ সালে শুধুমাত্র আমেরিকাতে নিবন্ধনকৃত এই গরুর সংখ্যা ছিল ৪০ মিলিয়ন এর বেশি।এছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় পালনকৃত ১.৬ মিলিয়ন ডেইরি গরুর প্রায় ৬০-৭০% ই হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান। ল্যাটিন আমেরিকা থেকে নিউজিল্যান্ড, কানাডা থেকে জাপান পর্যন্ত পৃথিবীর এমন কোনো গরু পালনকারী ভূখণ্ড নাই যেখানে কালো সাদা ব্র্যান্ডিং হয় নাই। তবে সর্বোচ্চ সংখ্যা পালনকারী দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, ইংল্যান্ড, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্ডিয়া।
বৈশিষ্ট্য ও সুবিধা :
হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান তাদের সাদা কালো রং তাদেরকে সহজেই সেনার উপায় করে দিয়েছে। একটা হোলস্টাইন জাতের পূর্ণ বয়স্ক গাভীর ওজন ৮০০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ১১০০ কেজি পর্যন্ত হয় এবং উচ্চতা ৫৫- ৭০ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। একটা হোলস্টাইন গভীর বাছুর এর ওজন ৪০ থেকে ৬০ কেজি পর্যন্ত হয়। পৃথিবীর সর্বোচ্চ দুধ উৎপাদনের যত রেকর্ড সবই এই সাদা কালো বাহিনীর দখলে এবং মাংসের বাজারেও তাদের সরব উপস্থিতি। মূলত সাদা কালো হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা এটা বিভিন্ন রঙের গরুর সাথে ক্রস মাদ্ধমে বিভিন্ন রং ও বৈশিষ্ঠের হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান গরু দেখা যায়। মা অথবা ষাঁড় এর রং এর নির্ভর করে লাল সাদা ফ্রিজিয়ান ও দেখা যায়। নরম জাতের এবং দুর্বল হজম ক্ষমতার গরু হিসাবে পরিচিত হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান সাদা খুর বিশিষ্ট হয়ে থাকে। মাথার উপরে সাদা টিক দেখে সহজে সনাক্তযোগ্য হলেও বিশুদ্ধ কালো জাতের গরু ও দেখা যায়।
দুধ ও মাংস উৎপাদন :
এক ল্যাক্টেশন পিরিয়ড এ হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান অ্যাভারেজ ৯০০০ থেকে ১২০০০ কেজি দুধ দেয় এবং দুধ উত্পাদনকাল ৩০০-৩১০ দিন। মিল্ক ফ্যাট ৩.৮ থেকে ৪.৮ এবং মিল্ক প্রোটিন ২.৮ থেকে ৩.৭ এবং ল্যাক্টোজ ৩.৭ থেকে ৫.৩ ( ডাচ হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, জাত ভেদে পরিবর্তন হতে পারে)। মাংস উৎপাদন এই জাতের গরু পালনের মূল উদ্দেশ্য না হলেও মাংসের বাজারে রয়েছে ফ্রিজিয়ান এর বহুল উপস্থিতি কারণ পৃথিবীর মোট গরু পালনের ৫০% এর উপরে শুধু এই জাত পালন করা হয়। হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান ষাঁড় সাইজে বেশ বড় হওয়ায় মাংস উৎপাদন ও সন্তোষজনক, যে কারণে এটা ডুয়াল পারপাস (মাংস ও গরু) গরু না হয়েও এটা অলিখিত ডুয়াল পারপাস গরু।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব :
যদিও এই জাতের গরু পালন সবচে চ্যালেন্জিং এবং ব্যয়বহুল তারপর ও পুরো পৃথিবীর দুধ কেন্দ্রিক অর্থনীতির চালিকাশক্তি হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান, কারণ ভালো জাতের গরু না হলে দুধ উৎপাদনে কোনোভাবেই লাভবান হওয়া সম্ভব না। তবে এই জাতের দুধের মান ভালো না হওয়ায় এবং দুধের পুষ্টি উপাদান কম হওয়ায় এই জাতের দুধের দাম অন্য সব দুধের চেয়ে কম। তবে দুধের উৎপাদন পরিমানে সবচে বেশি হওয়ায় এই জাতের গরু পালন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লাভজনক। এছাড়া ষাঁড়ের সাইজও বড় হওয়ায়, মাংস কেন্দ্রিক অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে এই জাতের গরু।
জীবনকাল :
এই জাতের গরুর জীবনকাল ছোট হওয়ায় দুধ উৎপাদন সময় ও খুব কম। ইংল্যান্ডে এই জাতের গরুর গড় জীবনকাল ১২-১৪ বছর, দুধ উৎপাদন ৩.২ উৎপাদনকাল এবং বাচ্চাপ্রদান গড়ে ৫ টি। এই জাতের গরু সাধারণত অ্যাভারেজ ৭-৮ বছর নিয়মিত দুধ দেয় যদিও দুধ উৎপাদনের ৪ থেকে ৫ বছর পর থেকে দুধ উৎপাদন কমতে থাকে । উৎপাদনের তৃতীয় এবং চতুর্থ বছর সর্বোচ্চ দুধ দেয়।
হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান পালনে সমস্যা :
পৃথিবীর প্রধান দুধ উৎপাদনকারী জাত হলেও এই জাতের রয়েছে কিছু সমস্যা যেটা অনেক খামারি কাটিয়ে উঠতে পারেনা। এই জাতের গরু পালন অভিজ্ঞ এবং ট্রেনিংপ্রাপ্ত খামারি ছাড়া খুব কঠিন। আর একটা বড় সমস্যা হলো প্রজনন সমস্যা। হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান গরু প্রায়ই প্রজনন অক্ষম হয়ে পড়ে। তাছাড়া প্রজননে দুর্বল হওয়ায় গড়ে ৪ স্ট্রও দরকার হয় যা বেশিরভাগ গরুর ক্ষেত্রে আরো কম। এছাড়া এই জাতের গরু স্বাস্থ্যের বেলায় বেশ অনুভূতিশীল এবং চিকিৎসা খরচ সবচে বেশি। এছাড়া নতুন আবহাওয়া তে মানিয়ে নিতে দীর্ঘ সময় লাগে। খাবার এবং রক্ষনাবেক্ষন খরচ বেশি হওয়ায় অনেকে এই জাতের গরু থেকে সহজে লাভ তুলতে পারেনা।
You must log in to post a comment.